কভিড-১৯ মহামারী সংকটে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বেশকিছু দেশে সেখানকার ধনীদের কাছ থেকে কর আদায়ের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করছে, বাংলাদেশেও করহার বাড়ানো প্রয়োজন। সংস্থাটি বলছে, যদি দেশের বিত্তশালীদের কাছ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে সুষম বণ্টন করা না যায়, তাহলে তা হবে কর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে সর্বোচ্চ করহার আগের মতো ৩০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছে সিপিডি। এছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেট সম্প্রসারণমূলক করারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
গতকাল এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরার সময় এসব সুপারিশ করে সিপিডি। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, বছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কত হবে, মহামারীর মধ্যে এটি আলোচনার সময় নয়। এখন সময় হচ্ছে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দেয়ার। তাই সরকার ৩৫ লাখ পরিবারকে যে পরিমাণ নগদ সহায়তা দিচ্ছে, সেটি আরো বাড়ানো উচিত বলে মনে করে তারা। একই সঙ্গে পরিবারের সংখ্যা ও নগদ সহায়তার পরিধিও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত, সেটির ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
ধনীদের কাছ থেকে করহার বৃদ্ধির প্রস্তাবনায় তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, গত অর্থবছরের কর কাঠামোতে করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতি ও সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই ধনীদের ওপর করের হার আবার ৩০ শতাংশে ফিরিয়ে নেয়া উচিত। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ধনীদের কাছ থেকে কর আহরণ হার বাড়িয়েছে। বর্তমান সংকটকালে আমরা যদি সম্পদশালীদের কাছ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে সুষম বণ্টন করতে না পারি, তাহলে তা কর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। এছাড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে কভিডকালে যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, তা আগামীতে অব্যাহত রাখার কথাও বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ আর রাখা ঠিক হবে না। আগামী অর্থবছর থেকে এ সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব করে তিনি বলেন, কারণ এ সুবিধা কর কাঠামোর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। বরং যারা কর শনাক্তকরণ নম্বর নিয়েছেন, তাদের করের আওতায় আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে চারটি খাতের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। এগুলো হলো কভিড মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে সেবা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। তৃতীয়ত, কর্মসংস্থান তৈরিতে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং চতুর্থত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রফতানিমুখী শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া।
সভায় মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার গরিব মানুষকে নতুন করে নগদ সহায়তা দিতে যাচ্ছে। সত্যিকারের গরিব মানুষ যাতে এ সহায়তা পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ প্রণোদনার চেয়ে নগদ সহায়তা বেশি উপকারী। এ টাকায় চাহিদা তৈরি হয়। অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। তাই নগদ সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে গরিব মানুষের সংখ্যা ও সহায়তার পরিধিও বাড়ানো উচিত। বছরে দুই থেকে তিনবার গরিব মানুষকে নগদ সহায়তার ব্যবস্থা করার প্রস্তাবও করেন তিনি।
এ সময় ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমাদের এখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই জিডিপি যদি কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারে, তাহলে এ প্রবৃদ্ধির কোনো অর্থই হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে। তাতে ওই দেশের কী হয়েছে, সে প্রশ্নও রাখেন তিনি। তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর সময় নয় বলে মন্তব্য করেন নির্বাহী পরিচালক।
সিপিডি বলেছে, করোনার কারণে অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যেন বাস্তবসম্মত হয়। স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত যেসব সরঞ্জাম রয়েছে, সেসব আমদানিতে কর পরিহারের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। ভিড-১৯ মহামারীকালে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষা কার্যক্রমে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখ করে সিপিডি ইন্টারনেট সেবায় সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ ও সারচার্জ ১ শতাংশ প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। কভিডের কারণে সংস্কার কার্যক্রম যেন পিছিয়ে না যায়, সেদিকে নজর দেয়ার কথাও বলা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। স্বাস্থ্য খাতে যারা সম্মুখসারিতে আছেন, তারা এখনো প্রণোদনার টাকা পাননি। তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব প্রণোদনার অর্থছাড়ের তাগিদ দিয়েছে সিপিডি।