সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি। তবে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই উত্তপ্ত রাজপথ। নিজেদের শক্তির জানান দিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ‘পালটাপালটি’ কর্মসূচি পালন করে চলেছে। ইতোমধ্যে শেষ বার্তা দিয়েছে দুদলই। শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, সরকারকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। পূজার ছুটির মধ্যে পদত্যাগ করে ‘সেফ এক্সিট’ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দলটি হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। অন্যথায় ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে সরকার পতনে লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া হবে। দুদলের শেষ বার্তার দিকেই এখন সবার নজর। তবে বড় দুদলের অনড় অবস্থানের প্রকাশ ঘটলেও এখানেই শেষ দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, সংঘাত এড়াতে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগোতে হবে দুপক্ষকেই। শেষ বার্তা দিয়ে প্রকাশ্যে উত্তাপ ছড়ালেও অন্তরালে দুপক্ষের রফা হতে পারে বলেও আশা করছেন তাদের কেউ কেউ।
তফশিল ঘোষণার আগের দিনগুলোকে রাজনীতিতে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসাবে দেখছে রাজনৈতিক মহল। সূত্রমতে, ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত টানা কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অভিমুখে পদযাত্রা ও ঘেরাও এবং সড়কপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচি। ঢাকার পাশাপাশি জেলা ও মহানগরেও একই কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। আবার আওয়ামী লীগও রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য দলটি বিরোধীদের কর্মসূচির ওপর নজর রাখছে। ‘পালটাপালটি’ না বললেও প্রায় একই ধরনের কর্মসূচির কথা ভাবছে ক্ষমতাসীনরাও। তারাও মাঠ ছাড়তে নারাজ।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমাদের শেষ বার্তা দিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং আবারও তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে আসবেন। সেটাই যদি মনে করেন তিনি নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাহলে তো নির্বাচনের প্রয়োজনই নেই। কোনো দরকার নেই। আমাদের নির্বাচনে অংশ নিতে যে বাধা সৃষ্টি করছেন, নির্বাচনে আসতে দিতে চাচ্ছেন না, তার একটাই কারণ তারা চান খালি মাঠে যেটাকে আমরা বলি ওয়াকওভার, সেই ওয়াকওভার হয়ে যাওয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির প্রতিটি সমাবেশে মানুষের ঢল নামছে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আসছে। বিএনপি আবারও ২৮ অক্টোবর কর্মসূচি দিয়েছে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আর থামবে না। আশা করছি, পূজার ছুটির মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন, পদত্যাগ করে সসম্মানে সেফ এক্সিট নেবেন। সরকারকে আবারও আহ্বান জানাই, জনগণের ভাষা, তাদের আওয়াজ বুঝে পদত্যাগ করুন। জনগণের দাবি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি একেক সময় একেক দফা দিচ্ছে। আবার খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ৪৮ ঘণ্টা আলটিমেটাম দিয়েছিল। এসব তাদের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্যই বলা। আমরা আবারও বলছি, সংবিধান অনুযায়ীই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের কর্মসূচি আছে, থাকবে। রাজপথে ছিলাম, থাকব। কোনোরকম নৈরাজ্য হলে তা মোকাবিলা করব।
এদিকে দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের পালটাপালটি অবস্থানে উদ্বেগ ছড়ালেও সমঝোতার আশা হারাচ্ছেন না রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা। তারা মনে করেন, দলগুলোর অনড় অবস্থান সাধারণ নাগরিকদের শঙ্কিত করে তুলছে। তবে অনড় অবস্থানের প্রকাশ ঘটলেও এখানেই শেষ ভাবা ঠিক হবে না। দুদলকেই স্বউদ্যোগী হয়ে জনগণের কথা ভেবে আলোচনা করতে হবে, সমঝোতায় আসতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ক্ষমতাসীন দলের। দুদলই গোঁ ধরে রাখলে এ ইমিচ্যুরিটির জন্য মাশুল দিতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনের আগে একেবারে সংঘাত হয়নি তা বলা মুশকিল। তবে দেখা দরকার তফশিল ঘোষণা যখন হবে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা। বিএনপি নির্বাচনে গেলে এক ধরনের রাজনীতি, না গেলে অন্য ধরনের রাজনীতি হবে। যদিও তার কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছে, নির্বাচনে না গেলে কী হতে পারে। তবে এখন আন্তর্জাতিক কমিউনিটি যার ওপর ভর করে কথা বলছিল, তারা তো সে ধরনের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা এখন বলছেন না। বলছে, সংবিধান পরিবর্তন তাদের দায়িত্ব নয়। সব মিলিয়ে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সমঝোতা তখনই হয় যখন জনগণ চায়। রাজধানীতে ৩০-৪০ হাজার লোক হলো সে নিয়ে তো দেশের রাজনীতি কখনো পরিবর্তন হয়নি। লাখ লাখ জনগণ দেশজুড়ে যখন বড় আকারে দাবি করবে, তখন পরিবর্তন হবে। তখন সংলাপ বা আলোচনায় বসার একটা সিদ্ধান্ত থাকে। কিন্তু এমনিতে জনগণ যদি না চায় কিংবা সরকারি দল যদি মনে করে সমপরিমাণ জনগণ তাদের সঙ্গেও আছে, তাহলে আমি মনে করি সমঝোতা হওয়ার কথা নয়।
তবে যে কোনো অনড় অবস্থানই শঙ্কার উদ্বেগ তৈরি করে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। তার মতে, যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থানই তো মানুষের মধ্যে একটা আশঙ্কা তৈরি করে। এই রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বাভাবিকভাবে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করে। আমরা সেটা চাই না। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকুক। কারণ আমাদের জীবনযাত্রা এমনিতেই তো চাপের মুখে আছে, এটার ওপর বাড়তি কোনো চাপ না পড়ুক, এটাই আমাদের চাওয়া।
সমঝোতার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, আশা করি শেষ পর্যন্ত তারা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান খুঁজে পাবে। এটিই উত্তম পথ, শুভবুদ্ধির পথ। তার মধ্য দিয়েই একটা সর্বজন, সর্বদলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হবে, একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।