দিন দিন কমছে সংরক্ষিত বনভূমি। এসব বনভূমি জবরদখল করে হাট-বাজার, দোকান, রিসোর্ট, বাড়িঘর, কৃষি খামার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। সরকারি হিসাবে প্রায় দেড় লাখ একর সংরক্ষিত বনভূমি অন্যদের দখলে চলে গেছে। এ ছাড়া মোট বনাঞ্চলের প্রায় তিন লাখ একর বেদখলে রয়েছে। অন্যদিকে দখলমুক্ত করা বনভূমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮০০ একর।
দখলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বন অধিদপ্তরের অধীন কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। সরকারের রাজস্ব আদায়ের নামেও ধ্বংস হচ্ছে বন। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ব্যক্তিরা বলছেন, ৯৩ বছরের পুরনো বন আইন, সনাতন পদ্ধতিতে বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাসহ কার্যকর তদারকি ও জবাবদিহির অভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে না বনভূমি। মন্ত্রণালয় বন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও সেটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে।
এই অবস্থায় আজ রবিবার পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক বন দিবস ২০২১’। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে সব ধরনের বন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রতিবছর ২১ মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে বন দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘বন পুনরুদ্ধার : উত্তরণ ও কল্যাণের পথ’।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারে আমরা জোরেশোরে কাজ করছি। অবৈধ দখলদারদের নাম ও জমির পরিমাণ আমরা ওয়েবসাইটে দিয়ে দিয়েছি। বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিয়মিতই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বন আইন সংশোধনেও কাজ করছে মন্ত্রণালয়। সেটিও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা শেষ করার চেষ্টা করব।’
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৫.৫৮ শতাংশ। এর মধ্যে বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের প্রায় ১০.৭৪ শতাংশ। সারা দেশে মোট ৩৩ লাখ ১০ হাজার ৯০৭ একর সংরক্ষিত বনভূমির এক লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর ৮৮ হাজার ২১৫ জনের দখলে রয়েছে। এর মধ্যে ১৪০ জন দখলকারী ৮২০ একর সংরক্ষিত বনভূমিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানা স্থাপন করেছেন। পাঁচ হাজার ৯৮২ জন ১৪ হাজার ১৪৯ একর সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে হাট-বাজার, দোকান, রিসোর্ট, কটেজ, কৃষি খামার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। ৮২ হাজার ৯৩ জন এক লাখ ২৩ হাজার ৬৪৩ একর সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি তৈরি করেছেন। সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত বনভূমি দখলে রয়েছে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে জমা দেওয়া হিসাবে প্রায় সাড়ে ৮০০ একর বনভূমি পুনরুদ্ধার দেখানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ১৯২৭ সালে করা বন আইনে বনের সংজ্ঞা, ধরন, সংরক্ষণপ্রক্রিয়া ও উন্নয়নকাজে বনের জমি ব্যবহার ও বরাদ্দ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই এবং এসংক্রান্ত বিধিমালাও নেই। সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংরক্ষিত বনের মর্যাদা রহিতকরণের সুযোগ (ধারা ২৭) রাখা হলেও এ ক্ষেত্রে বন অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি গ্রহণ ও কী প্রক্রিয়ায় রহিত করা হবে, তা বলা হয়নি। ফলে ঢালাওভাবে বনভূমি ব্যবহারের সুযোগ বিদ্যমান।
এ ছাড়া বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-তে সংকটাপন্ন ও বিপন্ন বন্য প্রাণীর প্রতিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ও তা সুরক্ষায় কী করা হবে, তা উল্লেখ নেই এবং এসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করার কোনো বিধানও রাখা হয়নি। করাতকল (লাইসেন্স) বিধিমালা ২০১২-এর বিধি ৭(ক)-এ পৌর এলাকায় করাতকল স্থাপন ও পরিচালনার সুযোগ থাকায় সংরক্ষিত বনের পাশে বা মধ্যে অবস্থিত পৌর এলাকায় করাতকল স্থাপন করে সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনের গাছ চুরির ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি জবরদখল করা হলেও অধিদপ্তর সর্বশেষ পাঁচ বছরে মাত্র আট হাজার ৭৯২ একর উদ্ধার করতে পেরেছে। বনভূমি উদ্ধারের তৎপরতাও তেমন একটা নেই বলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বনকর্মীদের একাংশের ক্ষমতার অপব্যবহার ও ন্যায়সংগত প্রয়োগের ঘাটতি বিদ্যমান। স্থানীয় ভূমি কার্যালয়, সেটলমেন্ট ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মী ও বনকর্মীদের একাংশের যোগসাজশে ভুয়া দলিল ও নথি তৈরি এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ডভুক্তির অভিযোগ রয়েছে। নীতিনির্ধারকদের একাংশের বন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতে সম্পৃক্ত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। বন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তাদের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ৬১ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রধান বন সংরক্ষকদের একাংশসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ, পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে পদভেদে ৫০ হাজার থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বিধিবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে অবৈধ পথে বনজ সম্পদ বিক্রি করার সুযোগ ও জমির উচ্চমূল্য ইত্যাদি বিবেচনায় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পছন্দের পদে আসেন বনকর্মীরা।
সূত্র জানায়, বন খাত থেকে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য দেওয়া হয়। রাজস্ব আহরণের নামে বনকর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। বন মামলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ নেই এবং রিটেইনার ফি বাবদ ন্যূনতম বরাদ্দ রয়েছে। বনায়ন, বনভূমি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পরিচালনার লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তির (যেমন—জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং) ব্যবহার সম্প্রসারণ করা হয়নি। বনভূমির জমির দলিল, রেকর্ডপত্র ও মানচিত্র, মামলার আলামত ইত্যাদি এখনো সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করায় তা বিনষ্ট, চুরি ও হারিয়ে যাওয়ায় বনভূমি জবরদখলের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের ২২.৩৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশের বেশি উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা চরে বনায়নের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে এক হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূমি দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বর্তমান সরকার সুন্দরবন সংরক্ষণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে; যার ফলে সুন্দরবনের বৃক্ষসম্পদের পরিমাণ বেড়েছে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় বন জরিপের তথ্য মতে সুন্দরবনে মোট কার্বন মজুদের পরিমাণ ১৩৯ মিলিয়ন টন, যেখানে ২০০৯ সালে পরিচালিত জরিপ অনুসারে এর পরিমাণ ছিল ১০৭ মিলিয়ন টন। আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রকিবুল হাসান মুকুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংরক্ষিত বনভূমি জবরদখল বা অবৈধ কর্তন রোধে কার্যকর কোনো আইন নেই। ১৯২৭ সালের বন আইন অনুসারে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে বন বিভাগকে জেলা প্রশাসকের কাছে মামলা দিতে হয়। এতে প্রক্রিয়াগত জটিলতায় অনেক সময় চলে যায়, যা অবৈধ দখল রোধের অন্তরায়।’