নানা খাতে অর্থ তছরুপের তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। গত এক দশকে প্রতিষ্ঠানের নানা খাতে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং লুটপাট হয়েছে ৩০২ কোটি টাকা। পুরো আর্থিক অনিয়মের পেছনে সাবেক একজন অধ্যক্ষ, গভর্নিং বডির সভাপতি এবং একজন সহকারী প্রকৌশলীর দায় মিলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক তদন্তে।
শনিবার (১৮ নভেম্বর) রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ গভর্নিং বডির বিদায়ী সংবর্ধনা ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মিজানুর রহমান ব্যাখ্যায় ‘শত কোটি টাকা তছরুপ বা অনিয়ম’ শিরোনামের সংবাদ ও ডিআইএ রিপোর্টের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। পরে এ ব্যাখ্যার একটি কপি পাঠানো হয়।
সেখানে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, ডিআইএ তদন্ত প্রতিবেদনটি মিথ্যা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র। ব্যাখ্যায় প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ফলাফল দেশসেরা। এ ফলাফলের পেছনে নিয়োগ করা দক্ষ শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ একটি পরিবার। এর সদস্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা, সম্মানিত অভিভাবক, দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলী ও পরিচালনা পর্ষদ। এ প্রতিষ্ঠান প্রচলিত আইন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিধিনিষেধ মেনে চলছে এবং চলতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু একটি সরকারি তদন্ত নথি সামাজিক মাধ্যম বা গণমাধ্যমে চলে আসায় বিশাল পরিবার বিব্রত বোধ করছে। আমাদের উত্তর বা ব্যাখ্যা দেওয়ার আগেই এমন খবর হেয় করার শামিল। ‘ডিআইএ’ প্রতিবেদনকে কিছু গণমাধ্যম কৃষ্ণ বা দুর্নীতি হিসেবে চালিয়ে দিতে চেয়েছে, যা সত্য নয়। আমরা জানি, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এত শত মিথ্যা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে, বরাবরই করবে। কেননা, সততাই আমাদের শক্তি, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আমাদের প্রেরণা।
হাতে রেখে ৯৭ কোটি খরচ
ডিআইএ তদন্তে বলা হয়েছে, আইডিয়াল স্কুলে কর্তৃপক্ষ হাতে রেখে মোট ৯৭ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ৩১৭ টাকা খরচ করেছে, যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ওই তদন্তে থাকা কর্মকর্তারা। নিয়ম অনুযায়ী, দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা হাতে রাখার বিধান থাকলেও শুধু একটি শাখা ৭৮ কোটি টাকা খরচ করেছে— এটা তো সরাসরি আত্মসাৎ! এমন অনিয়মে প্রতিষ্ঠান-প্রধান ও জিবির (গভর্নিং বডি) সভাপতির বিরুদ্ধে এসআরও ১৫৭ ধারায় মামলা করা সুপারিশ করেছে ডিআইএ। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ নয়ছয়ের বিষয়ে আইডিয়াল স্কুল কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা হলো, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স, বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট ও ট্যাক্স, বিভিন্ন ধরনের পাবলিক পরীক্ষার বোর্ড ফি ইত্যাদি অ্যাকাউন্ট পে চেকের মাধ্যমে করা যায় না। এগুলো নগদ লেনদেনে করতে হয়। আসলে বিধির বাইরে কোনো অর্থই হাতে নগদ রেখে ব্যয় করা হয় না।
গভর্নিং বডির সম্মানী, কন্টিনজেন্সি, নির্বাচন মামলার খরচ কোটি টাকা
আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্যরা বিভিন্ন মিটিং সম্মানী বাবদ, নির্বাচন পরিচালনা, গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা জন্য প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে এক কোটি এক লাখ ৭০ হাজার ১৪ টাকা খরচ করা হয়েছে। এ খরচকে অস্বাভাবিক ও অনিয়মতান্ত্রিক বলছে ডিআইএ। কিন্তু আইডিয়ালের ব্যাখ্যা হলো, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা নীতিমালায় গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যরা রিসোর্স পারসন হিসেবে সম্মানির নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট না থাকলেও নিষেধ নেই। এটি একটি রেওয়াজ বটে। কন্টিনজেন্সি খরচ– বিভিন্ন পরিদর্শন, নিরীক্ষণ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আসেন। তাদের আপ্যায়নসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নীতিমালার আলোকে নির্দিষ্ট সময়ে গভর্নিং বডির নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। এ খাতে ব্যয় গভর্নিং বডির সম্মতিতে হয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে মামলা পরিচালনা বাবদ ৪২ লাখ খরচ
ডিআইএ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গভর্নিং বডির সভাপতি ও অন্য সদস্যের নামে বিভিন্ন সময় দায়ের করার মামলা পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে ৪২ লাখ। এ পুরো টাকায় স্কুলের ফান্ড থেকে বহন করা হয়েছে। এ টাকা খরচ করাও বেআইনি হয়েছে। তবে আইডিয়াল স্কুল বলছে, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের মামলা রয়েছে, যার আইনি মোকাবিলার ক্ষেত্রে গভর্নিং বডির অনুমোদন সাপেক্ষে পাকা ভাউচারের মাধ্যমে ব্যয় করা হয়েছে।
অধ্যক্ষ ও সহকারী অধ্যক্ষের দায়িত্ব ভাতা
মতিঝিল মূল শাখা ছাড়াও আইডিয়াল স্কুলের মুগদা ও বনশ্রী আরও দুটি শাখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের একজন অধ্যক্ষ থাকায় তিনি আরও দুটি শাখায় দেখভাল বা দায়িত্ব পালন করেন। এজন্য অধ্যক্ষ দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা! তিন শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষকরা দায়িত্বভার নিয়েছেন। সবমিলিয়ে অধ্যক্ষ ও সহকারী প্রধান শিক্ষকরা শুধু দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন তিন কোটি দুই লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এ দায়িত্ব ভাতা নেওয়ার যুক্তিসংগত হিসেবে দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাখ্যায় বলেছে, প্রায় ২৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা জন্য তারা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তে তাদের এ দায়িত্ব ভাতা প্রদান করা হয়েছে।
পূর্ত কাজ, গাড়ি কেনা, জেনারেটর ও জ্বালানি খাতের ব্যয় ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯৪ হাজার
ডিআইএ প্রতিবেদন বলছে, প্রতিষ্ঠানটির তিনটি গাড়ি থাকলেও প্রতি শাখায় তিনটি গাড়ির তথ্য দিয়ে জ্বালানি খরচের বিল করা হয়েছে ৫৩ লাখ ৭১ হাজার ১৮৪ টাকা। তিন গাড়ির মেরামতে ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮২ টাকা খরচেও বিধি মানা হয়নি। পরে দরপত্র ছাড়াই ১২ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কেনা হয়। জেনারেটরের জ্বালানি ও মেরামতে ২২ লাখ ৯৮ হাজার ৬২২ টাকা খরচ করা হয়েছে। আরও কয়েকটি খাত মিলিয়ে মোট ব্যয় ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা, যেখানে বিধি মানা হয়নি। এর ব্যাখ্যায় আইডিয়াল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিষ্ঠানের পূর্ব বড় কাজগুলো শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে সময়সাপেক্ষ বিধায় সরকারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে করা হয়েছে। পূর্বে শতভাগ অনুসরণ করা না হলেও গত ২০১৭ সাল থেকে ব্যয়/ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি খাতে দায়সারা ব্যাখ্যা দিলেও নৈমিত্তিক ছুটির নামে ২০ কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা, সময়ের আগেই পদোন্নতি, অতিরিক্ত অর্ধ কোটি টাকা নেওয়া, বিধিবহির্ভূত ৭০ কোটি টাকার এফডিআর, বনশ্রী-মুগদা শাখায় তছরুপ হওয়া ১০ কোটি টাকা, তহবিলের ১৪ কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা, সংস্কার উন্নয়নের নামে লুটপাট ৪৪ কোটি টাকাসহ আরও কয়েকটি খাতের অস্বাভাবিক ব্যয়ের হিসাব দিতে পারেনি আইডিয়াল।
আইডিয়ালের এমন ব্যাখ্যার ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান ও ডিআইএ যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইডিয়াল স্কুল কর্তৃপক্ষ তদন্ত প্রতিবেদনের আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা এখনও দেয়নি। সংবাদমাধ্যমে যেসব ব্যাখ্যা তারা দিয়েছেন তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আমরা যেসব আর্থিক অসঙ্গতির তথ্য তুলে ধরেছি প্রতিটির দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। হাতে রেখে সর্বোচ্চ ৫ হাজার খরচ করার বিধান থাকলেও তারা ৯৭ কোটি খরচ করেছে, এর ব্যাখ্যা দুই লাইনে দিয়ে দিলেই হয়ে যাবে!