সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ঝুঁকি নিতে চাইবে না সরকার। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ‘লুণ্ঠন’ বন্ধ করতে পারলে ভর্তুকি অনেকটাই কমে আসবে। এসব বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিৎ।
জানা গেছে, আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে পূর্বে দেওয়া শর্তের বাস্তবায়নের খোঁজখবর নিতে গত সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন দফতরে সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করে সংস্থাটি। এরমধ্যে গত ১২ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) বিদ্যুৎ বিভাগ এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এদিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গেও বৈঠক করে সফররত দলটি। তার আগের দিন তারা বৈঠক করেছে জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে। এছাড়াও সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বিভাগের সঙ্গেও আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক চলে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক বিষয়ে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তা কিভাবে সমন্বয় করা হবে, সেটিও জানতে চেয়েছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। দীর্ঘ সময় চলা এ বৈঠকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারের কী পরিমাণ ব্যয় করতে হচ্ছে; এ নিয়ে সরকারের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোসহ অন্যান্য সংস্কারমূলক কর্মসূচির অগ্রগতি কতটুকু বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে জানতে চেয়েছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল।
এছাড়াও বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরে সঙ্গে আইএমএফের বাংলাদেশ মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। বৈঠকে ক্যাপাসিটি চার্জের পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ও আয়ের অবস্থা এবং এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিন বিকেলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে বৈঠক করেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ প্রতিনিধি দল পিডিবির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে পিডিবির কর্মকর্তারা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেন।
তারও আগে প্রতিনিধি দলটি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং পেট্রোবাংলা ও বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে জ্বালানি খাতের সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চায় আইএমএফ। এসব বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর বিষয়েই মূলত তাগিদ দিচ্ছে আইএমএফ। ভর্তুকি কমাতে গেলে দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে তেল-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়বে ভেবে আপাতত দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার।
চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানে আগ্রহী হয় আইএমএফ। বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের বিপরীতে আইএমএফ বেশ কিছু শর্ত দিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ছিল বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি ধাপে ধাপে শূন্যে নামিয়ে আনা। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। যা পরদিন (১ মার্চ) থেকেই কার্যকর করা হয়। এ নিয়ে সরকারের ১৪ বছরের মেয়াদে গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। তারও আগে ১৮ জানুয়ারি গ্যাসের দাম বাড়ায় সরকার।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অযৌক্তিক ব্যয় কমানো গেলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। ‘লুন্ঠনমূলক’ ব্যয় কমিয়েও ভর্তুকি সমন্বয় করা যায়। এ বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা তো বরাবরই বলে আসছি তারা প্রাইমারি এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, ট্রান্সমিশন, ডিস্ট্রিবিউশন, সব জায়গাতেই যৌক্তিক ব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে। সে সমস্ত ব্যয়কে প্রতিযোগিতা আইনের ১৬ ধারার মতে লুন্ঠনমূলক ব্যয় সম্পৃক্ত রয়েছে। এ কারণে যৌক্তিক ব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভর্তুকি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সব ব্যয়গুলো যদি যৌক্তিক করা হয় এবং এবং বিদ্যুৎকে যদি লুণ্ঠনমূলক ব্যয় থেকে প্রতিরোধ করা যায় তবে ব্যয় বৃদ্ধি প্রতিরোধ হয়, ভর্তুকি সমন্বয় হয়, আইনও প্রতিপালিত হয়।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমিয়ে এনে আইএমএফ এর যে শর্ত পালনের ব্যাপারটি সরকার যেভাবে দেখছে আমরা মনে করি এই খাতের ব্যয় যৌক্তিক করে অনেক বেশি ভর্তুকি কমানো যায়। গ্যাসের কত কোটি টাকা বছরে যাচ্ছে, বিদ্যুতে কত টাকা যাচ্ছে সেগুলো হিসেব করে গণশুনানিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দেখিয়েছি। এখন সেক্ষেত্রে যদি সরকার গণশুনানি বন্ধ করে ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রাখেতে চায়, লুণ্ঠনমূলক ব্যয়কে সুরক্ষা দিতে চায় তাহলে মূল্য বৃদ্ধি করে ভর্তুকি সমন্বয় করে আইএমএফকে সন্তুষ্ট করতে পারে, কিন্তু সেটা তো মানুষের জন্য জাস্টিজ হবে না।