ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরমধ্যেই ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে মাঠের রাজনীতিতে সরব দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি। গেল বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠের মহাসমাবেশের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় দলটি। এরপর থেকে দেশব্যাপী মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি, হরতাল ও অবরোধ পালন করে আসছে তারা। তবে সরকার পক্ষ থেকে ধরপাকড় শুরু হলে আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে। আত্মগোপনে যায় দলটির নেতাকর্মীরা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে আবারও রাজপথে নামে বিএনপি। ঘোষণা করে অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির। তবে হঠাৎ এই ঘোষণায় কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক নেতা জানিয়েছেন, অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারে দলীয়ভাবে আলোচনা হয়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে এই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।
ড. রাশেদা রওনক খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি বলছেন, মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে এই কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। তারা হয়তো অসহযোগের মাধ্যমে চমক দিতে চেয়েছে।
এই বিশ্লেষক বলেন, আদালতে হাজিরা, কর, বিল বা খাজনা না দেওয়ার বিষয়গুলো বাস্তবসম্মত নয়। বিএনপি হয়তো রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে দিয়েছে। তবে দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জন্য এসব বিষয় এড়িয়ে চলা সহজ কাজ হবে না।
কী বলছেন মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানিকগঞ্জ বিএনপির এক নেতা বলেছেন, নেতারা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তারাই বলতে পারবেন। তবে এখনই অসহযোগ না দিয়ে আগে সবার কারাবরণ কর্মসূচি দিলে তা বেশি কাজে লাগতো।
তৃণমূল পর্যায়ের এই নেতা বলেন, আমাদের অসংখ্য নেতকর্মী জেলে। আমরাও যেতাম। একযোগে কারাবরণ করতাম। এখন কর, খাজনা কিংবা বিল না দিয়ে কয়জন পরিস্থিতি সামলাতে পারবে?
কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই ধারণা করেছেন তারা ধীরে ধীরে অসহযোগ আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছেন। তবে এত দ্রুত এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে তা তারা ভাবতেও পারেননি। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে ধারণা পাওয়া গেছে, অসহযোগের এই কর্মসূচি অনেকটা তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই দেওয়া হয়েছে।
তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর কেউ কেউ অসহযোগের বিষয়টি জানতেন। আবার অনেকেই ঘোষণার পরই জেনেছেন।
নেতারা বলছেন, পরিষেবা বিল, ট্যাক্স, খাজনা না দেওয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হলেও বেশকিছু কৌশল আছে এতে। ব্যাংক লেনদেন না করার পরামর্শ এর মধ্যে অন্যতম। জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল, ‘ব্যাংকগুলো এই অবৈধ সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কি না সেটি ভাবুন।’
এদিকে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনেকেই ব্যাংক মালিক ও পরিচালক। রয়েছেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীও। তাদের পক্ষে ব্যাংক এড়িয়ে চলা অসম্ভব। এর বাইরেও দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা ব্যাংকে টাকা জমা রাখা থেকে কতটা বিরত থাকবেন সেই প্রশ্নও আছে দলের ভেতরে।
কায়সার কামাল বলেন, দেশের মানুষ জানে ব্যাংকগুলো ও অর্থনীতির চিত্র কতটা ভয়াবহ। সে কারণেই আমরা সতর্ক করে বলেছি যে এখন এসব ব্যাংকে মানুষ তার কষ্টার্জিত টাকা রাখবে কি না সেটা যেন তারা ভেবে দেখে।
এছাড়া বিএনপির ঘোষণায় তাদের ভাষায় ‘মিথ্যা ও গায়েবি মামলায়’ অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও অন্যদের আদালতে মামলায় হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার নিম্ন আদালতে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। অসহযোগ ঘোষণার পরদিনই ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় হাজিরা দিতে দেখা গেছে অনেক নেতাকর্মীকে।
কায়সার কামাল বলেন, এই সরকারের আমলে তারা ন্যায়বিচার পাবে না সেটা সবাই জানে। আমাদের বহু নেতাকর্মী কারাগারে, অনেককে একতরফাভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। তাই হাজিরা দিয়ে লাভ কী? বিএনপি সেটিই বলতে চেয়েছে।
কী কৌশল আছে অসহযোগ আন্দোলনে?
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী বলেছেন, অসহযোগের সাথে দেওয়া কর্মসূচিগুলোতে কিছু কৌশল আছে। যেমন- অসহযোগে সরাসরি ব্যাংকিং কার্যক্রম এড়িয়ে চলতে বা বাদ দিতে বলা হয়নি। বলা হয়েছে, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা কতটা নিরাপদ সেটি চিন্তা করতে। আবার গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য পরিষেবার বিল ৩ মাস পর্যন্ত জমা না দিলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
নেতারা বলেছেন, এখন ৩ মাস না দিয়ে পরে জরিমানাসহ পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। এতে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। আর আদালতে হাজিরা না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে- কারণ দলটির বেশির ভাগ সক্রিয় নেতাই এখন জেলে এবং বিভিন্ন মামলায় অনেকের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে বিএনপির এক নেতা বলেন, অল্প কিছু নেতা দণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, যারা হাজিরা দিতে আসলেই জেলে চলে যেতে হবে। সম্ভবত এই কারণেই আর কাউকে হাজিরা না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, কর্মসূচি দেখে তার মনে হয়েছে বিএনপি কিছুটা চমক দিতে চেয়েছে। বিএনপি হয়তো ভেবেছে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আকর্ষণীয় কর্মসূচি দিয়ে তারা রাজনীতির মাঠে থাকতে চেয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপি যে সব নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলো হয়তো বাস্তবসম্মত হয়নি। এর কারণ হতে পারে এই কর্মসূচির ক্ষেত্রে হয়তো খুব বেশি ভাবেননি তারা। কীভাবে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে সেটিই হয়তো বেশি চিন্তায় এসেছে।
বিএনপি নেতা কায়সার কামাল বলছেন, আগামী কয়েকদিন মানুষকে এসব বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে মাঠে নামবে বিএনপি। একতরফা নির্বাচন করে দেশকে ভয়ঙ্কর সংকটে ফেলে দিচ্ছে সরকার। ব্যাংকগুলো অচল হয়ে গেছে লুটপাটের কারণ। কোথাও কেউ ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। সেবা নেই, কিন্তু বিল, কর ও খাজনা দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
তিনি জানান, আগামী কয়েকদিন বিএনপি এসব বিষয়ই মানুষের কাছে তুলে ধরবে ও বলবে সরকারের পতনই এই অবস্থার একমাত্র সমাধান। সূত্র: বিবিসি