আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে। এ বিষয়ে একটি অ্যাপ তৈরিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আসনভিত্তিক সব তথ্য থাকবে এতে। অ্যাপসটি তৈরি হবে স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে। এবার পরিবর্তন আসছে আসন পুনর্নির্ধারণের পদ্ধতিতে।
ইসি সূত্র জানায়, ইসিকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হলেও বিতর্ক ও ঝামেলা এড়াতে এবার জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, প্রশাসনিক এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে গুরুত্ব দিয়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে। এ কারণে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় এ ধরনের পরিবর্তন আনতে চায় না ইসি। তাহলে ঢাকার সংসদীয় আসন বাড়াতে হবে।
আগে সীমানা নির্ধারণ করতে আইনি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। কোনো কোনো সীমানার ভোটার বা প্রার্থীরা এর বিরুদ্ধে মামলাও করতেন। ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ছিল ওই এলাকার ভোট। কিন্তু ২০২১ সালে নির্বাচন কমিশনকে আইনের অধীনে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়ে ‘জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ’ আইন পাস হয়। আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, ইসির সীমানা নির্ধারণের বিষয় নিয়ে দেশের কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
সংবিধান ও সীমানা নির্ধারণ আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংবিধানের ১১৯ (গ) অনুচ্ছেদে ইসিকে সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।
১২৪ অনুচ্ছেদে ইসিকে আইনের দ্বারা নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ করতে বলা হয়। সেই আইন ছিল না বলে ‘সংসদ নির্বাচন এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিধান অধ্যাদেশ-১৯৭৬’ জারি করা হয়। আইনের ৮ নম্বর ধারায় একটি উপধারা যুক্ত করা হয়। সেখানে বলা আছে, দৈব-দুর্বিপাকে বা অন্য কোনো কারণে আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ করা না গেলে বিদ্যমান সীমানার আলোকে নির্বাচন হবে।
আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ঘনত্বের বিষয়টিই বিবেচনা করা হতো। এবার প্রশাসনিক অখণ্ডতা ধরে হলেও জাতীয় সংসদের অন্তত ৪৫টি আসনের এলাকা পরিবর্তন হবে। তবে এর সংখ্যা কমবেশি হতে পারে বলেও ইসির একাধিক সূত্র জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছে।
এখন পর্যন্ত সীমানা পুনর্নির্ধারণের ১৮টি আবেদন জমা পড়েছে ইসিতে। তাই এই কাজের জন্য জনসংখ্যার সবশেষ তালিকা চেয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে চিঠি দিয়েছিল ইসি। এরপর ব্যুরো একটি খসড়া তালিকাও পাঠিয়েছে ইসিতে। কারণ এখনো জনশুমারির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়নি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গেলে নানা ধরনের প্রশাসনিক অসুবিধা সৃষ্টি হবে। তাই সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অখণ্ডতার বিষয়টি এবার সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দিতে গেলে রাজধানী ঢাকায়ই আরও ১০টি আসন বাড়াতে হবে। দেখা যাবে, এক উপজেলার বাসিন্দাকে ভোট দিতে হচ্ছে অন্য কোনো উপজেলার প্রার্থীকে। তবে এবার সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা এবার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করবো।
জানা যায়, ইসির ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে ৩০০ আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হবে। এর আগে ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা নিয়ে খসড়া তালিকা প্রণয়ন করা হবে আগামী মার্চের মধ্যে। আর এপ্রিলে তা প্রকাশ করা হবে। এরপর দাবি, আপত্তি অথবা সুপারিশ আহ্বান করবে ইসি। মে মাসে আপত্তির বিষয়ে অঞ্চলভিত্তিক শুনানি নিষ্পত্তি করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।
নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, সীমানা পুনর্নির্ধারণের ব্যাপারে একটি অ্যাপ তৈরিরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেখানে আসনভিত্তিক সব তথ্য থাকবে। স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে এই অ্যাপস তৈরি হবে। সীমানা নির্ধারণের কাজটি মে মাসের মধ্যে হয়ে যাবে। না হলে জুন মাসের মধ্যেই শেষ করতে পারবো।
বদলে যাওয়ার অপেক্ষায় ৪৫ আসন
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৪৫টি সংসদীয় আসন পরিবর্তনের তালিকায় রয়েছে। তবে এর সংখ্যা বাড়তে পারে। বর্তমানে এক উপজেলার ইউনিয়ন ভাগ হয়ে অন্য সংসদীয় আসনে চলে গেছে এমন সংসদীয় আসন রয়েছে ৪৫টি। আসনগুলো হলো ঠাকুরগাঁও-২, ঠাকুরগাঁও-৩, সিরাজগঞ্জ-১, সিরাজগঞ্জ-২, পাবনা-১, পাবনা-২, চুয়াডাঙ্গা-১, চুয়াডাঙ্গা-২, ঝিনাইদহ-২, ঝিনাইদহ-৪, যশোর-৩, যশোর-৪, মাগুরা-১, মাগুরা-২, নড়াইল-১, নড়াইল-২, খুলনা-৩, খুলনা-৪, সাতক্ষীরা-৩, সাতক্ষীরা-৪, মানিকগঞ্জ-২, মানিকগঞ্জ-৩, ঢাকা-২, ঢাকা-৩, ঢাকা-১৯, গাজীপুর-৩, গাজীপুর-৫, নরসিংদী-১, নরসিংদী-২, নারায়ণগঞ্জ-৪, নারায়ণগঞ্জ-৫, ফরিদপুর-২, ফরিদপুর-৪, গোপালগঞ্জ-১, গোপালগঞ্জ-২, মাদারীপুর-২, মাদারীপুর-৩, নোয়াখালী-১, নোয়াখালী-২, লক্ষ্মীপুর-২, লক্ষ্মীপুর-৩, চট্টগ্রাম-৭, চট্টগ্রাম-৮, চট্টগ্রাম-১৪ ও চট্টগ্রাম-১৫।
জনশুমারি ও গৃহগণনার খসড়ার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হতে আরও সময় লাগতে পারে। এরই মধ্যে জেলাভিত্তিক জনসংখ্যার হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। উপজেলাভিত্তিক হিসাব প্রস্তুতের কাজ চলছে। তাই চূড়ান্ত জনশুমারি প্রকাশ না হলে এসব ধরেই সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে।
আইন অনুযায়ী কোনো কারণে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা না গেলে বিদ্যমান আসনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও আইনে আদমশুমারির ভিত্তিতে যতদূর সম্ভব বাস্তবভিত্তিক বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চায় ইসি।
জানা যায়, ১৯৮৪, ১৯৯১ সালের পর ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। ওই বছর নবম সংসদ নির্বাচনের জন্য এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন শতাধিক সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনে। এরপর কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ কমিশন দশম সংসদ নির্বাচনে ৫০টি আসনে ছোটখাটো পরিবর্তন আনে। সবশেষ কেএম নূরুল হুদা কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অল্পবিস্তর পরিবর্তন আনে ২৫টি আসনে।