বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে অর্থপাচার ও বেনামি ঋণ ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতের নজরদারি জোরদারের পরামর্শ দিয়েছে অর্থনীতি-বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ)।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে সোমবার (৬ নভেম্বর) বৈঠক করেছে ইআরএফ। এসময় ১০ জন সাংবাদিক উপস্থিত হয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো, ডলার সংকট নিরসন ও রিজার্ভ বাড়ানোসহ বর্তমান সংকট মেটাতে অর্থপাচার ও বেনামি ঋণ ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ, শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতের নজরদারি জোরদারসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে বৈঠকে সংগঠনটির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বি দেন ইআরএফ-এর সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা।
বৈঠকে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় হার ব্যবস্থা স্থিতিশীল করা এখনকার মূল চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এটা শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে না। এখানে বাজার সিন্ডিকেট আছে, বাজার তদারকিতে ঘাটতি আছে। আবার সিজনের একটা বিষয় আছে।
তিনি বলেন, অর্থনীতিতে একটি ক্রান্তিকাল যাচ্ছে, এটা সবার জানা। আমার ৩৬ বছরের চাকরি জীবনে এতো সংকট কখনো দেখিনি। একটি সময় কেবল বাজেট ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবের ঘাটতি নিয়ে ভাবতে হতো। এর সঙ্গে গতবছরের শেষভাগ থেকে দূর হয়েছে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি।
তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকে। এর সঙ্গে এখন আবার হরতাল অবরোধ যোগ হয়েছে। এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে বিদেশি বিনিয়োগ কমে শূন্যে নেমেছে। স্বল্প মেয়াদি বিদেশি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ কমেছে। আবার উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ ছাড়ে দেরি করছে। তবে এ সংকট শিগগিরই কেটে যাবে। আমরা এখন টানেলের শেষ প্রান্তে আছি। আগামী বছরের জুন নাগাদ অর্থনীতি আবার ভালোর দিকে যাবে। তখন আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত হবে। আগামী ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে এবং আগামী জুনে সাড়ে ৬ শতাংশে নামানোর যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে তা পূরণ হবে। সুদহার এক ধরনের বাজারভিত্তিক হয়ে গেছে। শিগগিরই বিনিময় হার ব্যবস্থাও বাজারভিত্তিক হয়ে যাবে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে দর কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ জানি না।
আব্দুর রউফ তালুকদার আরও বলেন, এটা স্বীকার করতে হবে অর্থপাচার খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল। হুন্ডির মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থপাচার হচ্ছিল তার চেয়ে ১০ গুণ হতো বাণিজ্যের আড়ালে। তবে এলসি তদারকির মাধ্যমে এরই মধ্যে ওভার ইনভয়েসিং কমানো গেছে।
তিনি বলেন, দুবাইতে যে ১৩ হাজার বাংলাদেশি কোম্পানি খুলেছে, পর্তুগালে আড়াই হাজার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছে, এটা বাংলাদেশ থেকেই পাচার করে সেখানে নেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যের আড়ালে এখন পাচার অনেক কমে এসেছে। আগে প্রতি মাসে যে ৮ বিলিয়নের মতো এলসি খোলা হতো তার দেড় বিলিয়নই ছিল ওভার ইনভয়েসিং।
গভর্নর বলেন, আইএমএফ যেসব বিষয় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচনায় নেয় না একটা সময় তা ৮ বিলিয়ন ছিল। এরই মধ্যে তা কমিয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের নামানো হয়েছে। ৭ বিলিয়ন থেকে ইডিএফ কমিয়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারে নামানো হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বিমানকে দেওয়া ৪০ কোটি ডলার থেকে প্রতি মাসে ১ কোটি ডলার করে ফেরত আসছে। এভাবে এক পর্যায়ে এসব কিছুই থাকবে না। তখন আইএমএফের হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
বৈঠক শেষে ইআরএফ-এর সভাপতি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো, ডলার সংকট নিরসন ও রিজার্ভ বাড়ানোসহ অর্থনীতিকে কীভাবে আরও স্থিতিশীল করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে ইআরএফ। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। এটা কমানো ওপর বেশি জোর দিয়েছে ইআরএফ। পাশাপাশি সুদহার ও এক্সচেঞ্জ রেট বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর উত্তরে গভর্নর অর্থনীতি খুব দ্রুতই স্থিতিশীল অবস্থার দিকে যাবে বলে আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে রিজার্ভ থেকে আর কোনো বিনিয়োগ করা হবে না।
ইআরএফ সভাপতি বলেন, বিলাসী পণ্য আমদানিতে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা যেন ঠিকমতো তদারকি করা হয়। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কোনোভাবেই যেন অর্থ পাচার না হয় সেবিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছে সংগঠনটি। তিনি বলেন, খেলাপিদের বার বার সুবিধা দেওয়ায় ঋণ পরিশোধের আগ্রহ কমে গেছে। তাই একাধিকবার ঋণ পুন:তফসিলের সুবিধা না দেওয়ার পরামর্শ ইআরএফ। এর উত্তরে গভর্নর জানান, ঋণ পুন:তফসিলের নিয়ম রয়েছে, এ বাইরে কাউকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।
ব্যাংকগুলো সর্বশেষ ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। তা অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আবার ব্যাংকগুলো নিজেরাও পুনঃতফসিল করেছে। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এরপরও গত বছরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের এই অঙ্ক ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পুনঃতফসিল করা ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতো।