ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দুই মাস পার করেছে। এই দুই মাসে দেশের অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও পরিবর্তন এসেছে। সরকারের দুই মাসে ক্রীড়াঙ্গনে যেসব উল্লেখযোগ্য ঘটনা-পদক্ষেপ ছিল একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কমিটি ভাঙা
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। দুই সপ্তাহের মধ্যেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জেলা-বিভাগীয়, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা এবং জেলা-বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি ভেঙে দেয়।
২১ আগস্ট এই কমিটি ভাঙার কিছু দিন পর অ্যাডহক কমিটি গঠনের একটি রুপরেখা প্রদান করে। এতে জেলা ক্রীড়া সংস্থা জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা বিভাগীয় কমিশনারকে গঠন করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে অনুমোদনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রশাসনিক রদবদলে অনেক জেলায় ডিসি পরিবর্তন হয়েছে। ফলে এখনো জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলো আনুষ্ঠানিক রুপ পায়নি। স্থানীয় পর্যায়ের ক্রীড়াঙ্গনে স্থবিরতাই বিরাজ করছে।
এক যোগে ৪২ সভাপতি অব্যাহতি
১৯৯৮ সাল থেকে ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ফেডারেশনের নির্বাচন হলেও ফুটবল, ক্রিকেট বাদে বাকি সকল ফেডারেশনে সভাপতি সরকার থেকে মনোনীত। দলীয় সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি গণই সভাপতি হিসেবে ছিলেন। ক্রীড়া সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও সরকার বিভিন্ন ফেডারেশনে এমন ব্যক্তি মনোনীত করত। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এক যোগে ৪২ ফেডারেশন/এসোসিয়েশন সভাপতিকে অব্যাহতি প্রদান করেছে। এক যোগে ৪২ ফেডারেশনের অব্যাহতির আগে কাবাডি, ব্রিজ ও দাবা ফেডারেশনের সভাপতিকে অপসারণ করেছিল।
বিসিবিতে রদবদল
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন নাজমুল হাসান পাপন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পাপন আত্মগোপনে। ক্রিকেট বোর্ডের এই শূন্যতা পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিসিবি সভাপতি হিসেবে পাপনের পদত্যাগের পর সাবেক জাতীয় অধিনায়ক ফারুক আহমেদকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কোটায় তাকে পরিচালক মনোনীত করে। পরবর্তীতে বিসিবির সভায় অন্য পরিচালকগণ তাকে সভাপতি নির্বাচিত করেন।
বিসিবিতে নির্বাচিত পরিচালকের পাশাপাশি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কোটায় ২ জন পরিচালক থাকেন। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার এনএসসি কোটায় দুই পরিচালক জালাল ইউনূস এবং আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববিকে পদত্যাগের অনুরোধ জানান। জালাল ইউনূস স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন ববি পদত্যাগ না করায় এনএসসি ববির স্থলে নাজমুল আবেদীন ফাহিমকে পরিচালক হিসেবে মনোনীত করে।
বাফুফে নির্বাচন ও সালাউদ্দিনের ‘ না ‘ ঘোষণা
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে সোচ্চার ছিল সাবেক ফুটবলার ও সমর্থকরা। পদত্যাগ তো নয়-ই উল্টো পঞ্চম মেয়াদে সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। সেই দৃঢ়চেতা সালাউদ্দিন আকস্মিকভাবে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যা ক্রীড়াঙ্গনে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
১৪ সেপ্টেম্বর সালাউদ্দিনের এই ঘোষণার পর দিনই ক্রীড়া সংগঠক সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তার ঘোষণার এক সপ্তাহ পর বাফুফের সাবেক সহ-সভাপতি তাবিথ আউয়ালও সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেন। আগামীকাল থেকে বাফুফে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ শুরু। ২৬ অক্টোবর বাফুফে নির্বাচন। অন্তর্বত্নীকালীন সরকারের অধীনে বাফুফে নির্বাচনই প্রথম হতে যাচ্ছে। ফিফার নির্দেশনায় বাফুফে নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। এরপরও বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিকতায় বাফুফে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হওয়া সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জই।
ফেডারেশন কর্তাদের পদত্যাগ ও খেলাধূলায় স্থবিরতা
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ক্রীড়াঙ্গনেও প্রভাব পড়ে। অনেক ফেডারেশনের কর্মকর্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তারা ফেডারেশনে স্ব স্ব পদ থেকে সরে দাঁড়ান। বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী আওয়ামী লীগের কয়েকবারের এমপি ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম পদত্যাগ করেন। এরপর অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব মন্টু, যুগ্ম সম্পাদক সরাফত আলী পদত্যাগ করেন। টেস্ট অভিষেক দলের অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ও বিসিবি পরিচালক থেকে পদত্যাগ করেন।
৫ আগস্টের পর থেকে জাতীয় পর্যায়ে তেমন কোনো খেলাধূলা চলছে না। প্রায় সকল ফেডারেশনের কমিটি এখনো বহাল আছে। কর্মকর্তারা শঙ্কায় রয়েছেন যে কোনো সময় কমিটি পরিবর্তন হতে পারে। তাই খেলাধূলা আয়োজনে তেমন উদ্যোগী নয়। ফুটবল, ক্রিকেটের একাধিক দল দেশের বাইরে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলছে। আরচ্যারি ও দাবাও বিদেশে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলছে। ঘরোয়া পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরের তেমন কোনো প্রতিযোগিতা কোনো ফেডারেশন আয়োজন করছে না।
সার্চ কমিটি গঠন
ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ২৯ আগস্ট পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে। দুই মাসের মধ্যে তাদেরকে বিভিন্ন ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র, কার্যক্রম সহ আনুষাঙ্গিক বিষয় পর্যালোচনা করে রিপোর্ট প্রদান করতে বলা হয়েছে। সার্চ কমিটি ইতোমধ্যে এক মাস পার করলেও এখনো দৃশ্যমান কিছু করতে পারেনি। বিভিন্ন ফেডারেশন সার্চ কমিটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে নিয়মিতভাবে ফেডারেশনের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বসছে সার্চ কমিটি। এর মধ্যে হকি নিয়ে একটু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। হকির এক পক্ষ সার্চ কমিটির সদস্য ইমরোজের অপসারণ চেয়েছে আরেক পক্ষ তার প্রতি আস্থা রেখেছে। সার্চ কমিটির এক সদস্য মহিউদ্দিন বুলবুলের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি খোদ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। তাই তাকে বদলে বিকেএসপির মহাপরিচালককে কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে রদবদল
ফেডারেশনগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই সরকারি প্রতিষ্ঠানে গত দুই মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দুই যুগের বেশি সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব ছিলেন রশিদুজ্জামান সেরনিয়াবাত। তাকে এখান থেকে সরিয়ে বান্দরবান স্টেডিয়ামের প্রশাসক করা হয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে দুই যুগ কাজ করেছেন কবিরুল হাসান। আইন কর্মকর্তার পদ স্থায়ী না হওয়ায় এবং তার কাজ সন্তোষজনক নয় বিধায় তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। বিভিন্ন স্টেডিয়ামের প্রশাসকদের রদবদলের পাশাপাশি এনএসসির প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আওতাধীন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দোকান ভাড়ার বিষয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা বিশেষ জোর দিয়েছেন। এজন্য একটি কমিটি গঠনও করেছেন।
পরিদপ্তরে আন্দোলন ও বদলি
ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আরেকটি অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ক্রীড়া পরিদপ্তর। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে দেশে ছয়টি শারীরিক শিক্ষা কলেজ রয়েছে এবং প্রতি জেলায় একজন করে ক্রীড়া অফিসার। ক্রীড়া অফিসার ও শারীরিক শিক্ষা কলেজের অনেকে বর্তমান পরিচালক তরিকুলের অপসারণ চেয়ে আন্দোলন করেছিল। এই আন্দোলনের নেপথ্যে ও নেতৃত্বে থাকা দুই কর্মকর্তাকে পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক থেকে বদলি করে ক্রীড়া অফিসার করা হয়েছে। পাশাপাশি পরিদপ্তরের পরিচালকের উপর আনীত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
সাফ অ-২০ চ্যাম্পিয়ন, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের এই স্বল্প সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্যও এনেছে। পাকিস্তানকে পাকিস্তানের মাটিতে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করার কীর্তি গড়েছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম বড় অর্জন। অসামান্য অর্জনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনুস ক্রিকেট দলকে ডেকে সম্মাননা জানান। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলেও সাফল্য এসেছে। সাফ অ-২০ চ্যাম্পিয়নশীপে বাংলাদেশ নেপালকে হারিয়ে নেপালের মাটিয়ে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া চ্যাম্পিয়ন দল দেশে আসার দিনই সংবর্ধনার আয়োজন করেন। তাৎক্ষণিকভাবে দলের সবাইকে ২৫ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কারের ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ দলের কোচ সেই অর্থ বন্যার্তদের প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন।
প্যারা অলিম্পিকে নতুন জিও এবং মতবিনিময়
প্যারিসে সামার অলিম্পিকের পরপরই ছিল প্যারা অলিম্পিক। বাংলাদেশের দুই প্যারা আরচ্যার এতে অংশ নিয়েছেন। দুই জন মাত্র খেলোয়াড় হলেও কর্মকর্তা সংখ্যা ছিল কয়েকগুণ। নাজমুল হাসান পাপন ক্রীড়া মন্ত্রী থাকাবস্থায় অধিক সংখ্যক কর্মকর্তা নিয়ে সরকারি আদেশও হয়েছিল। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া সেই আদেশ বাতিল করে নতুন আদেশ দেন। যেখানে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা যাওয়ার অনুমতি পান।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ক্রীড়া উপদেষ্টা হওয়ার এক মাসের মধ্যেই ক্রীড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ৷ যা আগে কোনো মন্ত্রী এত স্বল্প সময়ের মধ্যে করেননি। সাংবাদিকদের পর বিভিন্ন খেলার খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক, রেফারির সঙ্গে মত বিনিময়ের আয়োজন করেন।