মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর লড়াইয়ের কারণে রোহিঙ্গারা নিজেদের আদিনিবাস ছেড়ে রাজ্যের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশের প্রবেশের জন্য দেশটির মংডু সীমান্ত এলাকায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে৷ তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।
কয়েক মাস ধরেই মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়তে থাকে। দুই দেশের সীমান্ত এলাকা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ থেকে ওপারের গোলাগুলির শব্দ শোনা যায় প্রায়ই। এমন অবস্থায় সীমান্ত এলাকায় অনেকদিন ধরেই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
ওপারে সংঘাতময় পরিস্থিতি শুরুর পর বেশ কিছু লাশ নাফ নদী ধরে বাংলাদেশে ভেসে এসেছে৷ টেকনাফের একজন এনজিও কর্মী বাংলাদেশে বেশ কিছু লাশ দাফনের দাবি করেছেন৷
একজন রোহিঙ্গা বলেন, ড্রোন হামলায় মংডু এলাকায় তার নয়জন আত্মীয় নিহত হয়েছেন৷ আহত চারজন বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন৷ এদিকে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা ও টহল বাড়িয়েছে বিজিবি৷ অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে৷
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের মংডুতে ড্রোন হামলা চালানো হয়৷ গুলিও করা হয়৷ আরাকান আর্মি এই হামলা চালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ এতে অন্তত ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত অর্ধশত মরদেহ বাংলাদেশে ভেসে আসার খবর দিয়েছে৷
টেকনাফ এলাকার এনজিও কর্মী মাহবুব আলম মিনার বলেন, ‘আমার তত্ত্বাবধানেই ১৭০ জন রোহিঙ্গার লাশ আমরা এখানে দাফন করেছি৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাফন করা হয়েছে শাহপরীর দ্বীপে বড় মাদরাসা মসজিদের কবরস্থানে, সেখানে ৫৫টি লাশ দাফন করা হয়েছে।’
মাহবুব আলম দাবি করেন, ‘আমি যে তথ্য পেয়েছি তাতে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তের ওই পাড়ে কমপক্ষে সাত থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে।’
টেকনাফ এলাকার এক ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দুন নূর বলেন, ‘ড্রোন হামলা ও গুলিতে আমাদের পরিবারের চারজনসহ আমার পরিচিত মোট নয়জন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি৷ আহত অবস্থায় পালিয়ে আসতে পেরেছেন চারজন৷ তাদের মধ্যে আমার বোন ও তার ছেলে-মেয়েরা আছে৷ তাদের বাংলাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে সীমান্তের ওপারে ২০ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে৷ তাদের অবস্থা খুবই খারাপ।’
কুতুপালং ক্যাম্পের ইউনূস আরমান বলেন, ‘কিছু রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নভাবে আসছেন৷ তবে আসার অপেক্ষায় আছেন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা৷ তারা মংডুতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি উভয়ের তোপের মুখে আছেন।’’
মিয়ামারের আরাকানের সিটুএ-এর বাংলাদেশের সাবেক মিশন প্রধান মেজর (অব.) মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ফলে এখন মংডু এলাকার রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মির টার্গেটে পরিণত হয়েছে৷ ফলে ওই ড্রোন হামলা আরাকান আর্মি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তবে আমরা যে খবর পাচ্ছি তাতে প্রতিদিনই সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে৷ আর তারা সীমান্তে এসে জড়ো হচ্ছেন৷ সীমান্ত সিল করা থাকায় তারা বাংলাদেশে ঢুকতে পারছেন না।’
এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ সরকারের চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা দরকার৷ কারণ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক৷ ফলে চীনের মাধ্যমে এর সমাধান সহজ, যদি তাদের রাজি করানো যায়৷ আর আলাদাভাবে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা প্রয়োজন৷ আরাকান আর্মির সঙ্গেও ভিন্নভাবে যোগাযোগ প্রয়োজন। মংডুতে যা হচ্ছে, তা যদি না কমে, তাহলে বাংলাদেশ সীমান্তে চাপ বাড়তেই থাকবে৷ তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।’
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নিরাপত্তা ও টহল জোরদার করা হয়েছে৷ ফোর্সও বাড়ানো হয়েছে৷ এখন পর্যন্ত নতুন কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকতে পারেনি।’
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন (আরাকান) রাজ্য থেকে বাংলাদেশে স্রোতের মত ঢুকতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। যেখানে আগে থেকেই ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও করে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি রোহিঙ্গারা, ভেস্তে যায় আলোচনা।
এরপর কোভিড মহামারি এলে রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কমে যায়। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন বাধা।
এখন মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের কারণে প্রত্যাবাসনের আলোচনা আপাতত বন্ধ, উল্টো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে নতুন করে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সাত বছর আগে বাংলাদেশ সীমানা খুলে দেওয়া হলেও এখন রোহিঙ্গা অনু্প্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে সরকার।