দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ডাক বিভাগে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অধরাই রয়ে গেলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গদাইলষ্করি তালে চালাচ্ছে অনুসন্ধান। ডাক অধিদফতর গঠিত কমিটি তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেটিও দায়সারা গোছের। ফলে ডাক বিভাগ থেকে দুর্নীতির দায়ে বিদায় নেয়া মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্রের (এসএস ভদ্র) সহযোগিরা কার্যত রয়ে গেছেন অধরাই। তদন্তের নামে চলছে কালক্ষেপণ।
ডাক অধিদফতর সূত্র জানায়, বিভিন্ন প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ছিল এসএস ভদ্রের বিরুদ্ধে। তার নজিরবিহীন পুকুর চুরির পরীক্ষিত সহযোগী ছিলেন ডিপিএমজি মোস্তাক আহমেদ, নির্বাহী প্রকৌশলী শামীমুর রাজী, ডাক বিভাগের শাখা (পরিকল্পনা শাখা-১) কর্মকর্তা শংকর কুমার চক্রবর্তী, মেইল প্রসেসিং সেন্টার প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক শাহ আলম ভুইয়া, ডাক বিভাগের পরিদর্শক জসিম উদ্দিন, সহকারী জাকির হোসেন এবং ইলেকট্রিশিয়ান চাঁন মিয়া। তারা প্রত্যেকেই কম- বেশি এসএস ভদ্রের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা ভোগী। সীমিত বেতনের চাকরি করেও তারা নামে-বেনামে এখন বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক। কার কোথায় কি সম্পত্তি রয়েছে- গতবছর ২৫ ডিসেম্বর এ বিষয়ে তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়েছে। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পরপরই ডাক অধিদফতর থেকে পরিচালক মো. ইউনুছকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনও এসএস ভদ্র এবং তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে পৃথক অনুসন্ধানের ফাইল খোলে। ৫ মাসের বেশি অতিক্রান্ত হলেও কোনো সংস্থার প্রতিবেদনই কার্যত আলোর মুখ দেখেনি।
দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, এসএস ভদ্রের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধানটি শেষ পর্যায়ে। একটি সংস্থা থেকে রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছিল লকডাউন শুরুর আগে। লকডাউনের কারণে রেকর্ডপত্রগুলো এখনও হাতে আসেনি। এলেই মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি কমিশনে জমা দেয়া হবে। তবে দুদকের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত টাকা হাতিয়ে নেয়া এসএস ভদ্র দুদকের অনুসন্ধানটি বিলম্ব এবং ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। একই ভাবে তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া পৃথক অনুসন্ধানটিও যাতে আলোর মুখ না দেখে সে জন্যও তিনি মোটা অংকের অর্থলগ্নি করেছেন। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে উভয় তদন্তই তিনি কালক্ষেপণ এবং ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক মো.সালাহউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ‘অনুসন্ধানাধীন বিষয়’ নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, ডাক অধিদফতর থেকে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় সেটিও ছিল নিছক ‘আইওয়াশ’। ওই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের জমা দেয়া হলেও তদন্তটি হয়েছে দায়সারা গোছের। প্রতিবেদনে দুর্নীতির মূল বিষয়টিই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ও ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অধিদফতরের প্রতি কোনো নির্দেশনা দেয়নি। উপরন্তু ভদ্রের দুর্নীতির সহযোগিদের অনেকেই এখনও সপদে বহাল রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসএস ভদ্রের অন্যতম সহযোগী ডিপিএমজি মোস্তাক আহমেদ ডাক অধিদফতরের মহা-পরিচালকের দফতরেই রয়েছেন। তিনি ডাক বিভাগের পোস্টালের সার্ভারের মতো স্পর্শকাতর দায়িত্ব দিয়ে ওই কক্ষেই বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি এসএস ভদ্রের ই সেন্টার প্রকল্পের ডিপিডি ছিলেন। তিনি ৬/৭ বছর ডাক অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়েই কর্মরত আছেন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসএস ভদ্রের প্রকৌশল-সহযোগী শামীমুর রাজীকে নামকাওয়াস্তে রাজশাহীর পোস্টাল একাডেমিতে বদলি করা হয়। বদলির সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডাক অধিদফতরেই ‘সংযুক্ত’ করে রাখা হয়। বর্তমানে তিনি পরিচালক গোলাম মোস্তফা পরিচালিত ‘জরাজীর্ণ পোস্ট অফিস মেরামত প্রকল্প’র উপ-প্রকল্প পরিচালক। ভদ্রের বহুল বিতর্কিত ‘মেইল প্রসেসিং সেন্টার’ প্রকল্পের ডিপিডি ছিলেন শাহ আলম ভুইয়া। দুর্নীতির বিস্তারিত তথ্যসম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশের পরও তাকে একই প্রকল্পে রাখা হয়েছে।
ভদ্রের ‘বিশেষ সহকারী’ ছিলেন পরিদর্শক মো. জসিমউদ্দিন। তিনি এখনও মহাপরিচালকের ‘বিশেষ সহকারী’ হিসেবেই বহাল রয়েছেন। এ নামে কোনো পদ না থাকলেও জসিমউদ্দিনকে সংযুক্ত করেছিলেন তৎকালিন মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) এসএস ভদ্র। শঙ্কর কুমার চক্রবর্তীকে চট্টগ্রামে বদলি করা হলেও পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তার সুপারিশে তাকে ‘পোস্টমাস্টার, সেভিংস’ হিসেবে ঢাকাতেই রেখে দেয়া হয়েছে। ভদ্রের দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে তার সম্পৃক্ততাও প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। জাকির হোসেন নূর ডাক জীবনবীমা, ঢাকার অতিরিক্ত জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন ঢাকাতেই। তিনি ডিপিএমজি হিসেবে ‘পোস্টাল ক্যাশকার্ড’র ডিপিডি ছিলেন। এসএস ভদ্র ছিলেন এ প্রকল্পের পরিচালক। এ প্রকল্পের অর্থ হরিলুটে বড় সহযোগী ছিলেন ডিপিএমজি (পূর্বাঞ্চল, ঢাকা) জাকির হোসেন নূর। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে করা হয়েছে পুরস্কৃত। নূরকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ‘মনিটরিং’ করতে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘সংযুক্ত’ করা হয়েছে।
বিগত মহাপরিচালক এবং তার সহযোগিরা কি দুর্নীতি করেননি নাকি দুর্নীতি খুঁজে পাওয়া যায়নিÑ জানতে যোগাযোগ করা হয় ডাক অধিদফতর গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি ডাক বিভাগের পরিচালক মো. ইউনুসের সঙ্গে। জবাবে তিনি বলেন, আমি এখন ছুটিতে, ঢাকার বাইরে। পারিবারিক কাজে ব্যস্ত রয়েছি। আগামী সপ্তাহে ঢাকা এলে সরাসরি কথা বলতে পারব।
তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ডাক অধিদফতরের মহা-পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. সিরাজউদ্দিন বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। দায়সারা গোছের একটি তদন্ত হয়েছে। এটির ভিত্তিতে তো কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় না। আমি কমিটিকে আবারও তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছি। ‘যারা দায়সারা তদন্ত করলেন- তাদেরকেই কেন পুনরায় একই দায়িত্ব দিলেন?’ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, শিগগিরই আরেকটি কমিটি করব। আমি চাই প্রকৃত সত্য উঠে আসুক।