পাথর আমদানি বন্ধ হওয়ার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। ভারত থেকে টানা ২০ দিন ও ভুটান থেকে এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশের পাথর নির্ভর স্থলবন্দরে আমদানি বন্ধ থাকায় সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। বিপাকে পড়েছেন বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা।
স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, পাথরের ট্রাকবিহীন পড়ে আছে স্থলবন্দরের ইয়ার্ড। পাথর নেই, তাই পাথর ভাঙা ক্রাশিং মেশিনগুলোর শব্দ নেই। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বন্দরটির কয়েক হাজার শ্রমিক। বেকার হয়ে পড়েছেন লোড-আনলোড শ্রমিকরাও। তাদের জীবিকা চলে দৈনিক শ্রমের উপর। কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। অন্য কোনো কাজেও যেতে পারছেন না। ইমিগ্রেশনে যাত্রী পারাপারও চলছে ধীরগতিতেই।
বিপাকে পড়েছেন বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা। এই বন্দরে প্রতিদিন ৩৫০-৪৫০ ট্রাক পাথর প্রবেশ করলে গাড়ির চালক ও হেল্পারদের কর্মে মুখরিত হয়ে উঠতো চারপাশ। হোটেল ও দোকানগুলোতে বিক্রি বেড়ে যেত। এখন পাথর না আসায় কাস্টমারের অভাবে থমকে যাচ্ছে তাদের ব্যবসা। বিষয়টি দ্রুত নিরসন চান তারা।
অলস সময় পার করতে দেখা যায়, বন্দর সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বন্দরের শুল্ক স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, রাজস্ব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অলস সময় পার করছেন। পাথর ছাড়া অন্য যেসব পণ্য আমদানি-রপ্তানি চলমান রয়েছে, সেসব নিয়েই কাজ করছেন তারা। তবে বন্দরটি ৯৫ শতাংশ পাথর নির্ভর হওয়ায় ভারত ও ভুটান থেকে প্রতিদিন ৩৫০-৪৫০ ট্রাকে পাথর আমদানি হতো। সেখানে পাথর না আসায় বন্দরটি কর্মচাঞ্চল্য হারিয়েছে। এভাবে পাথর আমদানি বন্ধ থাকলে বন্দরটিতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে বলছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বেশি আদায় হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অর্থ বছরে ৫৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেন। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আদায় হয়েছে ৬৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। অর্থ বছরের জুন মাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আর আদায় হয় ১৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১২ কোটি ১৭ লাখ টাকা বেশি। কিন্তু পাথর আমদানি এভাবে বন্ধ থাকলে প্রত্যাশিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার।
ব্যবসায়ীরা জানান, ৩১ জুলাই শুল্ক বিভাগ ব্যবসায়ীদের চিঠি দিয়ে বলা হয়, প্রতি মেট্রিক টন ভারতীয় পাথরে (বোল্ডার) অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (শুল্ক) ১২ ডলার থেকে ১৩ ডলার করা হয়েছে। আর ভুটানের পাথরে (ভাঙা পাথর) প্রতি মেট্রিক টনে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (শুল্ক) ২১ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৪ ডলার করা হয়েছে। এ রেটে পাথর আমদানি করলে লোকসানে পড়তে হবে ভেবে তারা ১ আগস্ট থেকে পাথর আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন।
তারা আরও জানান, ভারতের ফুলবাড়ি স্থলবন্দরের ট্রাক চালকদের আন্দোলনের কারণে গত ১২ জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে ভুটানের পাথর আমদানি। ভুটান থেকে আমদানি করা পাথরের ট্রাকগুলো স্লট বুকিংয়ের (অনলাইন ফি নিবন্ধন) আওতায় আনতে ধর্মঘট করলে ভুটান থেকে পাথর আনা সম্ভব হচ্ছে না। পাথর আমদানি করতে না পারায় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তবে একমাত্র পাথর ছাড়া ভারত ও নেপাল থেকে মেশিনারিজ, প্লাস্টিক দানা, ভুট্টা, অয়েল কেক (খৈল), আদা, গম, চাল, ফল ইত্যাদি ও নেপাল ও ভুটান থেকে উৎপাদিত ও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। একই ভাবে দেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য, আলু, ব্যাটারি, কোমল পানীয়, গার্মেন্টস সামগ্রী, ক্যাপ, হ্যাঙ্গার, সাবান, বিস্কুট, চানাচুর, জুস, কাচ, পার্টস, কটনব্যাগ, ওষুধ, মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন দ্রব্য রপ্তানি চলমান রয়েছে।
বন্দরের শ্রমিকরা জানান, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি পাথর আমদানি দিয়ে শুরু হয়েছিল বন্দরের উদ্বোধনী কার্যক্রম। শতকরা ৯৫ ভাগই পাথর আমদানি হয়ে থাকে এ স্থলবন্দরে। বর্তমান মাস ধরে পাথর আসা বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে কর্মজীবী শ্রমিকরা। কাজ না থাকায় সারা দিন অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। আয়-রোজগার না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। শ্রমিকদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষাসহ বন্দরটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানি গ্রুপের সভাপতি আব্দুল লতিফ তারিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, একমাস ধরে আমাদের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর পাথর আমদানি বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা পাথর আমদানি করতে পারছেন না। এ বন্দরটি মূলত পাথরের উপর নির্ভরশীল। ৯০ ভাগই টেক্স আসে পাথরের মাধ্যমে। পাথর আমদানি বন্ধ থাকার কারণে সরকার যেমন রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি পাথরের উপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে প্রায় ২০-৩০ হাজার শ্রমিক বিভিন্নভাবে কাজ করে। সে শ্রমিকরা আজ বেকার, ব্যবসায়ীরা বেকার। তারা লসের কারণে এলসি করছে না। বিষয়টি নিয়ে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। লিখিত আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই বিষয়টি সমাধানে আসবে।
শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা তাপস কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে ভারত ও ভুটানের পাথর আমদানি বন্ধ রয়েছে। ভুটান থেকে পাথর আমদানি করতে হলে ভারতের ট্রানজিট ভিসা ব্যবহার করা হয়। স্লট বুকিংয়ের মাধ্যমে পাথর আমদানি করতে হয়। এটা ভারত ও ভুটানের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় ভুটানের পাথর আমদানিকারক আনতে পারছে না। এদিকে শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা ২০১২ এর ধারা অনুযায়ী নির্ধারণ করার পর ভারত থেকে পাথর আমদানি হচ্ছে না। আমদানিকারকরা কি কারণে আনছেন না সেটা তারাই ভালো জানেন। একমাত্র পাথর ছাড়া এ স্থলবন্দরের অন্য সকল পণ্য আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ২০ দিন হলো ভারতের পাথর আমদানি বন্ধ রয়েছে। বন্দরটি মূলত পাথরের উপর নির্ভরশীল। পাথর আমদানি বন্ধ থাকার কারণে বন্দরের সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। যারা স্টক হোল্ডার রয়েছেন, শ্রমিক রয়েছেন তারাও বেকার হয়ে পড়েছেন। বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহস্রাধিক শ্রমিক খুব কষ্টের মধ্যে রয়েছে। তাদের কোনো আয় রোজগার নেই। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে সরকারের যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা তা সেটা অর্জনে অনেকটা কঠিন হয়ে যাবে। তাই পাথর নির্ভর না হয়ে যদি আমদানি-রপ্তানিতে বহুমুখী করা যায় তাহলে এই ধরনের সমস্যা তৈরি হবে না। তাই বন্দর সংশ্লিষ্টদের প্রতি বিষয়টি নজর দেয়া উচিত। আশা করছি খুব শীঘ্রই এ সমস্যা নিরসন হয়ে আবার পাথর আমদানির মধ্য দিয়ে কর্মচাঞ্চল্য হয়ে উঠবে দেশের এই গুরত্বপূর্ণ চারদেশীয় স্থলবন্দরটি।