সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার শফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলামের নামে ৫ কোটি ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৩৩৪ টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) আদালতে দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত কার্যালয় সিলেটের উপপরিচালক মো. নূর ই আলম।
দুর্নীতি দমন কমিশনের দাখিল করা অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, দুদকের নোটিশ পেয়ে ২০১৮ সালের ২৮ জুন শফিক ও তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলাম দুদক সিলেট জেলা কার্যালয়ে সম্পদ বিবরণী জমা দেন। এতে অসঙ্গতি দেখে দুদক অনুসন্ধানে নামলে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি ধরা পড়ে। এক পর্যায়ে গত বছরের ২০ জানুয়ারি দুদক সিলেট জেলা কার্যালয়ে দুটি মামলা করা হয়। ১৩ মাসের তদন্ত শেষে সোমবার ও মঙ্গলবার সিলেটের মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মামলা নম্বর ১ এর অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, শফিকুল ইসলাম ২০১৮ সালের ২৮ জুন দুদকে দায়েরকৃত সম্পদ বিবরণীতে ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার স্থাবর সম্পদের হিসাব দেন। তদন্তে শফিকের নিজ নামে, তার ছেলে ও মেয়ের নামে মোট ৫২ লাখ ৯৬ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে তিনি ১৫ লাখ ৫১ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ গোপন করেছেন।
তিনি দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ৯৫ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৭ টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেন। তদন্তে শফিক, তার ছেলে-মেয়ের নামে ১ কোটি ৫১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭১ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে তিনি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ২১৫ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য দেন।
তিনি ৭১ লাখ ৬৪ হাজার ২১৫ টাকার অর্জিত সম্পদ গোপন করেন। তার উপার্জিত টাকা দ্বারা নিজ নামে ও সন্তানদের নামে ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৩ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ১ কোটি ৫১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭২ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ ২ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬৭২ টাকার সম্পদ অর্জন করেন।
দুদক তদন্তে পেয়েছে, তিনি পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে ৩২ লাখ ৭৩ হাজার ৫১২ টাকা খরচ করেছেন। তদন্তে তার নামে অর্জিত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৩৭ লাখ ১৬ হাজার ১৯০ টাকা। সকল রেকর্ড ও তথ্যাদি পর্যালোচনায় তার নিজ নামে অর্জিত সম্পদের মোট পরিমাণ পাওয়া যায় ১ কোটি ২০ লাখ ৩০ হাজার ১২৫ টাকা। তিনি ১ কোটি ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ টাকার সম্পদ অর্জনের বৈধ উৎস দাখিল করতে ব্যর্থ হন।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি গোপন রেখে ছেলের নামে ৮৬৮ দশমিক ৫ শতক জমি কেনেন। এর ফলে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলা নম্বর ২ এর অভিযোগপত্র থেকে পাওয়া গেছে, কাস্টমস কমিশনার শফিকের স্ত্রী মাহবুবা ইসলাম ২০১৮ সালের ৬ জুন সম্পদ বিবরণী দুদকে জমা দেন। এতে তিনি ১ কোটি ১০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের হিসাব দেন। তদন্তে তার নিজ নামে ১ কোটি ৮১ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৬ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে তিনি ৮১ লাখ ২৩ হাজার ৭০৬ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করেন।
তিনি সম্পদ বিবরণীতে ২ কোটি ২৫ লাখ ৮৮ হাজার ১১৯ টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেন। তদন্তকালে ২ কোটি ৪১ লাখ ১ হাজার ৪১২ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এতে তিনি ১৫ লাখ ১৪ হাজার ২৯৩ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করেন। তিনি দাখিলকৃত বিবরণীতে ৯৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯৯৯ টাকার সম্পদ গোপন করেন।
অভিযুক্ত কাস্টমস কমিশনার শফিকুল ইসলাম কিশোরগঞ্জের স্টেশন রোডের (তারাপাশা) নিকলী ভবনের নবী হোসেনের ছেলে। বর্তমানে তিনি রাজধানী ঢাকার বনানীর কে ব্লকের ২২ নম্বর রোডের ১৭৪ নম্বর হাউজে (ফ্ল্যাট নম্বর ১৭/৪) বসবাস করছেন। মাহবুবা ইসলাম কাস্টমস কমিশনার শফিকুল ইসলামের স্ত্রী।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার পদে তিনি যোগদান করেন। যোগদানের পর তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এমন অভিযোগের পর দুদকের তদন্ত চলাকালেই ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর তাকে সিলেট থেকে একই পদে ঢাকায় বদলি করা হয়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাহবুবা ইসলাম নিজ নামে স্থাবর ও অস্থাবরসহ মোট ৪ কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৮ টাকার সম্পদ অর্জন করেন। পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে ১৪ লাখ ৭ হাজার ১৫১ টাকা খরচ করেন। তার নামে অর্জিত সম্পদের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৪৩ হাজার ২৬৯ টাকা।
রেকর্ডপত্র ও প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বৈধভাবে তার আয়ের উৎসের পরিমাণ ৩১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। তিনি ৪ কোটি ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৬৯ টাকার সম্পদ অর্জনের বৈধ উৎস দাখিল করতে ব্যর্থ হন। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি গোপন রেখে ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেস কেনার জন্য ডেভোলপার কোম্পানিকে বিভিন্ন মানি রিসিটে প্রদত্ত টাকার পরিমাণ গোপন করেন। তিনিও দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় সিলেটের উপপরিচালক মো. নুর ই আলম বলেন, আমরা তদন্ত করেছি। পরবর্তীতে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছি।